|
বাংলাদেশের দক্ষিণের প্রত্যন্ত এক অঞ্চল নিঝুম দ্বীপ। এই দ্বীপের বনে হরিণের পাল ঘুরে বেড়ায়। জীবন বেশ প্রতিকূল। এই প্রতিকূলতার মধ্যে সেখানে বাস করে কয়েক হাজার মানুষ। মাছ ধরাই হচ্ছে এইসব মানুষের প্রধান পেশা। জোয়ার-ভাটার সঙ্গে তাল রেখে তাদের চলাচল। তাই যারা নিঝুম দ্বীপে বেড়াতে যান, তাদেরকেও জোয়ার-ভাটার সঙ্গে মিল রেখে চলতে হয়। এটা এক ধরনের রোমাঞ্চ। প্রতিবছর কিছু পর্যটক যান নিঝুম দ্বীপে।
তবে এই দ্বীপে যাওয়ার এবং সেখানে থাকার সুব্যবস্থা না থাকায় পর্যটকদের খুব একটা টানে না দ্বীপটি। কিন্তু আপনি যদি রোমাঞ্চ-প্রিয় হন, তাহলে সময় সুযোগ মতো ঘুরে আসতে পারেন নিঝুম দ্বীপ থেকে। যদি হরিণ দেখতে চান, তাহলে আপনাকে যেতে হবে চিড়িয়াখানায়। আর যদি ভাবেন বনের এই অবলা প্রাণীদের বনের পরিবেশে দেখবেন, তাহলে আপনাকে যেতে হবে সুন্দরবনে। কিন্তু সুন্দরবনে বাঘের ভয় আছে।
হরিণ দেখতে কখন না আবার বাঘের খাবার হয়ে যেতে হয়, তার কি কিছু ঠিক আছে! তাছাড়া সুন্দরবনে যেতে হলে অনেক ঝক্কি-ঝামেলাও পোহাতে হয়। বনবিভাগের অনুমতির একটা বিষয় থাকে। আপনি যদি কোনো ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়া এবং বাঘের পেটে চালান হওয়ার ভয় ছাড়া হরিণ দেখতে চান, তাহলে আপনাকে নিঝুম দ্বীপেই যেতে হবে। ঢাকা থেকে নিঝুম দ্বীপ সম্পর্কে অনেক খবরই পাওয়া যায়।
শোনা যায়, নিঝুমের হাটে-বাজারে নাকি হরিণ ঘুরে বেড়ায়। হরিণ চলে আসে মানুষের আবাসস্থলে, আঙিনায়। ঢুকে পড়ে মানুষের ঘরের ভেতর। সত্যিই কি তাই? প্রচণ্ড ভীতু একটা প্রাণী এতটা সাহসী হলো কেমন করে? সেটা কি নিঝুমের আলোবাতাসের গুণে? হরিণের কথা শুনলেই নিঝুম দ্বীপে যাওয়ার আগ্রহ হতে পারে যে কারও। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে নোয়াখালীর সর্বদক্ষিণের দ্বীপটির নাম ছিল ইছামতি। নামের বিবর্তনে সেই ইছামতি দ্বীপই আজকের নিঝুম দ্বীপ।
জানা যায়, ১৯৫৭ সালে নিঝুম দ্বীপে মানুষের পদচারণা শুরু হয়। উত্তাল মেঘনা পাড়ি দিয়ে এখানে আসে মহিষপালক ওসমান বা ওসমান বাতাইন্যা। তার দেখাদেখি আরও কিছু বাতাইন্যা পাড়ি জমায় ইছামতিতে। বিস্তীর্ণ চরে তখন কেবল বালুর ঢিবি।
তারা তখন এর নাম দেয় বাওলার চর বা বাইল্যার চর। এর মাঝেই ভাঙতে শুরু করে হাতিয়া। হাতিয়ার নদী ভাঙা মানুষেরা নতুন আশ্রয়ের খোঁজে ছুটে আসে বাইল্যার চরে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসতি গড়তে শুরু করে। ১৯৫৯-৬০ সালে তখনকার ভূমি বিভাগের তত্ত্বাবধানে একটি জরিপ হয়।
জরিপে চিহ্নিত করা হয় ১ হাজার ৪৫৩.৫৩ একর আবাদি জমি। জরিপের সময় বাতাইন্যা সর্দার ওসমান বাতাইন্যা জরিপকারীদের সহায়তা করেন। জরিপকারীরাও বাইল্যার চরের নাম দেন চর ওসমান।
|
|
মৌজার নাম দেওয়া হয় চর ওসমান মৌজা। এখনো এই নিঝুম দ্বীপ চর ওসমান মৌজার অন্তর্গত। দিন যতই গড়াতে থাকে, চরের পরিধি ততই বাড়তে থাকে। এই দ্বীপের নাম নিঝুম দ্বীপ হওয়ার কারণ আছে। ১৯৭২ সালের আগে এই দ্বীপে নিয়মিত মানুষ বাস করত না। কেবল মাঝে মাঝে শুটকি শুকানোর জন্য বা মহিষ চারণের জন্য এখানে এসে মানুষ থাকত। বছরের বাকি সময়ে পুরো দ্বীপ থাকত বিরান। খাঁখাঁ করত দ্বীপ।
লোকালয় থেকে অনেক দূরে নিঝুম এক ভূখণ্ড ছিল বলেই এই দ্বীপের নাম হয়ে যায় নিঝুম দ্বীপ। বর্তমানে এই দ্বীপের আয়তন ৬৩ বর্গকিলোমিটার। বাংলাপিডিয়ার তথ্যানুযায়ী বাইল্যার চর, কামলার চর, চর ওসমান ও চর মুরি এই চারটি প্রধান দ্বীপ ও বেশ কয়েকটি ছোট ছোট চরের সমন্বয়ে নিঝুম দ্বীপ গঠিত। জমির পরিমাণ ১৪ হাজার ৫০ একর। ঢাকা থেকে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার দুটো উপায় আছে। ঢাকার সদরঘাট থেকে হাতিয়াগামী লঞ্চে করে সোজা হাতিয়া।
ঢাকা থেকে হাতিয়াগামী লঞ্চ মাত্র একটি এমভি পানামা। সদরঘাট থেকে একদিন পর একদিন বিকাল সাড়ে ৫টায় ছাড়ে। হাতিয়া পৌঁছায় পরদিন সকালে। যারা নদীযাত্রায় আনন্দ পান, তারা লঞ্চে গেলে মজা পাবেন। লঞ্চে যেতে যেতে মজার দৃশ্য দেখার সুযোগ হবে না। কারণ রাতের অন্ধকারে নদীর দুপাশে কিছুই দেখা যায় না। কেবল অনেক দূরে নদী পারে লাইটের আলো যখন চোখে পড়বে, তখন ওই লাইটের আলোগুলোকে তারা মনে হতে পারে।
লঞ্চে ডেকের ভাড়া ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা। আর কেবিনের ভাড়া সিঙ্গেল ৬০০ টাকা এবং ডাবল ১ হাজার টাকা। লঞ্চে রাতের খাবারের ব্যবস্থা আছে। ডেকে যেতে হলে আগে থেকে জায়গা নিয়ে রাখতে হবে। তা না হলে ঝামেলায় পড়তে হয়। লঞ্চে যেতে যেতে ভোর হয় মেঘনা নদীতে। মেঘনা নদীতে সকালের সূর্যের রূপও দারুণ লাগে। দেখা যায় মেঘনার বুকে ছোট ছোট মাছ ধরার নৌকা। বেশির ভাগ নৌকাই ইলিশ ধরায় ব্যস্ত।
দেখা যাবে চর তমজুদ্দিনের ঘাটে কেমন করে গ্যাসে লাইন থেকে ২৪ ঘন্টা পানি পড়ে সেই দৃশ্য। ওই গ্যাস লাইনের সঙ্গে পাইপ টেনে রান্নার কাজে ব্যবহার করছে চর তমজুদ্দিনের মানুষ। দেখা যাবে সারি সারি সুপারি গাছ। হাতিয়ার ঠিক আগের ঘাট হচ্ছে চর মনপুরা।
|
একানব্বইয়ের ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বিখ্যাত চর মনপুরা এর মধ্যেই মেঘনার ভাঙনের শিকার হয়েছে। নদী ভাঙনের রূপও দেখা যায় লঞ্চে করে গেলে। হাতিয়া থেকে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ারও দুটি উপায় আছে। এক হচ্ছে সড়ক পথে। আর বিকল্প পথ হচ্ছে ট্রলার। সড়ক পথে অনেক ঝক্কি।
সড়ক পথে প্রথমে যেতে হয় জাহাজমারা ঘাট। হাতিয়া থেকে জাহাজমারা ঘাট যাওয়ার ছোট ছোট বাস আছে। যাওয়া যাবে স্কুটারে করেও। জাহাজমারা ঘাট থেকে খাল পাড়ি দিয়ে যেতে হয় বন্দরটিলা। এই বন্দরটিলা হচ্ছে নিঝুম দ্বীপের একটি জায়গা।
বন্দরটিলা থেকে হেঁটে বা রিকশায় করে সাত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আসতে হয় নিঝুম দ্বীপের বাজারে। সড়ক পথে না গিয়ে আপনি যদি ট্রলারে করে নিঝুম দ্বীপ যেতে চান, তাহলে ঝক্কি-ঝামেলা অনেক কম। হাতিয়া থেকে দুটো যাত্রীবাহী ট্রলার চলাচল করে সপ্তাহে দুদিন। রোববার ও বুধবার।
|
তবে লঞ্চে হাতিয়া পৌঁছলে যাত্রীবাহী ট্রলারের নাগাল পাওয়া যাবে না, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। কারণ লঞ্চ হাতিয়া পৌঁছায় ১০টার পর। আর যাত্রীবাহী ট্রলার হাতিয়া থেকে নিঝুম দ্বীপ ছেড়ে যায় আরও ঘন্টু দুই আগে। অবশ্য এর সঙ্গে জোয়ার-ভাটার একটা হিসেব আছে। কাজেই নিঝুম দ্বীপ যেতে হলে সরল সোজা কোনো হিসেবের উপর ভর করে যাওয়া বোকামি হবে। ওখানকার মানুষের জীবন ও জীবিকা সবকিছুই জোয়ার-ভাটার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
তবে হাতিয়া পৌঁছে এত সব ঝক্কি-ঝামেলা দেখে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেললে হবে না। দলে পর্যটকের সংখ্যা যদি বেশি থাকে, তাহলে একটি ট্রলার রিজার্ভ করে নিন। নয়তো খোঁজ করে জেনে নিন, কোনো মাছের ট্রলার নিঝুম দ্বীপ যাবে কিনা। এতে খরচ অনেক কমবে। ট্রলারে নিঝুম পৌঁছতে সময় নেবে দুই-আড়াই ঘন্টা। রিজার্ভ করা ছাড়া মাছের ট্রলারে ভাড়া লাগতে পারে জনপ্রতি ৫০-৬০ থেকে ১০০ টাকা। তবে দরদাম করে যাওয়াই উত্তম।
ট্রলারে করে যেতে যেতে হাতিয়ার সৌন্দর্যও উপভোগ করা যায়। এরপর নিঝুমের কাছাকাছি দেখা যাবে অতিথি পাখির মেলা। নিঝুম দ্বীপের যে খাল দিয়ে ট্রলার ঢুকবে, ওই খালের নাম চটাখালি খাল। চটাখালি খালে ঢোকার সময় যদি জোয়ার থাকে, তাহলে ভাগ্য ভালো। এই ট্রলারে করেই চলে যেতে পারবেন সোজা নিঝুম দ্বীপ বাজারে। আর ভাটা থাকলে নিঝুম দ্বীপে ঢোকার মুখেই আপনাকে নামিযে দেওয়া হবে। তখন অনেকটা পত হেঁটে হেঁটে যেতে হবে বাজারে।
এখানেই আছে পর্যটন করপোরেশনের একটি মোটেল। রুম ভাড়া ডাবল ৮০০ টাকা আর ডরমেটরিতে ২০০ টাকা প্রতি রাত। এছাড়া বোর্ডিংও আছে। সিঙ্গেল রুম ভাড়া প্রতিরাতের জন্য ৫০ টাকা ও ডবল রুমের জন্য ১০০ টাকা। নিঝুম দ্বীপে খাওয়া-দাওয়া করার জন্য বাজারে বেশ কয়েকটি খাবার রেস্টুরেন্ট আছে। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন, হরিণের দ্বীপে এলাম আর হরিণের মাংস চেখে দেখব না?
এমন যদি ভেবে থাকেন, তাহলে কাউকে আপনার সে ভাবনার কথা বলার আগেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন ওই ভাবনা। কারণ নিঝুম দ্বীপে হরিণের মাংস খাওয়া যায় না। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে তা একেবারেই অবৈধ। নিঝুম দ্বীপে এসে হরিণ দেখতে যেতে পারেন চটাখালি খালের পূর্ব পাশে, বনের পশ্চিমের বেলাভূমিতে। বিকেলবেলা ওই বিশাল মাঠে পালে পালে হরিণ জড়ো হয় ঘাস খাওয়ার জন্য। তবে হরিণ দেখতে যেতে হলে আপনাকে হাঁটতে হবে না।
কারণ ততক্ষনে জোয়ার চলে আসবে। আপনি নিশ্চিন্তে একটি নৌকা ভাড়া করে উঠে বসেত পারেন হরিণ দেখার জন্য। হরিণ দেখতে হয় অনেক দূর থেকে। কারণ ভীতু প্রাণী হিসেবে হরিণের একটা দুর্নাম আছে। এমনকি নিজের পেটের ভেতরেও যদি গুটুর গুটুর শব্দ হয়, তাতেও নাকি ভয়ে লাফিয়ে ওঠে হরিণ। হরিণ দেখার জন্য সঙ্গে বাইনোকুলার নিয়ে গেলে ভালো হয়। প্রাণ ভরে হরিণের চলাচল দেখা যাবে।
সারা বিকেল হরিণ দেখে সন্ধ্যের দিকে যখন ফিরবেন, তখন খালের পূর্ব পাশেও হরিণের দেখা মিলতে পারে। সন্ধ্যের দিকে হরিণ খালের পাড়ে আসে পানি পান করার জন্য। নিঝুম দ্বীপে রাতে দেখার মতো কিছু নেই। পরদিন সকালে হরিণ দেখার জন্য যেতে পারেন বন্দরটিলার বনে। চুপচাপ বসে বসে অপেক্ষা করলে একসময় হরিণই আপনার চারপাশে চলে আসবে। প্রাণ ভরে তখন হরিণ দেখতে পারবেন। তবে শব্দ করলেই হরিণ ছুটে চলে যাবে বনের ভেতরে।
নিঝুম থেকে ফিরে আসার সময় ওই একই ভাবে আসতে হবে। হয় ট্রলারে করে হাতিয়া, নয়তো সড়ক পথে জাহাজমারা হয়ে হাতিয়া। ফেরার পথে লঞ্চে করেও ফিরতে পারেন অথবা কোনোভাবেও ফিরতে পারেন। অনেক সময় নিঝুম দ্বীপ থেকেই সরাসরি নোয়াখালী পর্যন্ত মালবাহী ট্রলার চলাচল করে। নোয়াখালী ৪ নম্বর ঘাট পর্যন্ত যায় ওই ট্রলার। নোয়াখালী ৪ নম্বর ঘাট থেকে নেমে বাসে করে সোনাপুর। তারপর সোনাপুর থেকে সোজা ঢাকার বাসে ঢাকা।
আপনি ইচ্ছে করলে এ পথে নিঝুম দ্বীপ যেতেও পারেন। এ পথে নিঝুম দ্বীপ যেতে যদিও খরচ অনেক বেশি, তবে সময় বাঁচে। সে ক্ষেত্রে নোয়াখালী ৪ নম্বর ঘাট থেকে বিআইডব্লিউটিআইর হাতিয়া যাওয়ার সি-ট্রাক পাবেন। তবে যে পথেই নিঝুম দ্বীপ যান না কেন, নিঝুমের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই। মুগ্ধ করবে এখানকার মানুষের আতিথেয়তা।
বনে বা শেষ বিকেলে বেলাভূমিতে বিচরণকারী হরিণ আপনাকে মুগ্ধ না করে পারে না; তা আপনি যতই মুগ্ধতাবিমুখ মানুষ হন না কেন। আর এটাই হলো প্রকৃতির অপার শক্তি।
|
|
|
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন